কুমিল্লায় রমজানের শুরুতেই বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম,বাজার নিয়ন্ত্রণ সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ

অর্থনীতি

এম শাহীন আলম :
আজ থেকে সারা দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের সিয়াম সাধনার মাস রমজান শুরু। এদিকে রমজান শুরু হলেও কুমিল্লার কাঁচাবাজারে চাল থেকে শুরু করে ডাল,ভোজ্য তেল, পিয়াজ, মরিচ, আদা-রসুন, চিনিসহ রমজানে অতি ব্যবহৃত পণ্য ছোলা ও খেজুরের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া বেশকিছু দিন স্থির থাকার পর আজ বাজারে বেড়েছে সব ধরনের সবজির দাম। সেই সঙ্গে বেড়েছে ব্রয়লার ও দেশি মুরগির দামও। রোজার শুরুতে নিত্যপণ্যের এমন দাম বৃদ্ধিতে ক্রেতাদের মধ্যে রীতিমতো ‘নাভিশ্বাস’ উঠেছে। পাশাপাশি দাম বাড়ায় নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর চাপ আরো বেড়েছে। গতকাল শুক্রবার আজ শনিবার বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমনটাই চিত্র দেখা যায়।

বাজারে ক্রেতারা জানান পৃথিবীজুড়ে করোনার প্রাদুর্ভাব দেশে সর্বোএে লকডাউন,কর্মহীন মানুষের মধ্যে হাহাকার,তবে বিগত বছরের তুলনায় এবার করোনার মহামারিতে সীমিত আয়ের মানুষের জন্য এবারের পবিত্র রমজান মাস নিদারুণ কষ্টের। কারণ একদিকে গত বছরের রোজার তুলনায় এবার প্রায় সব নিত্য-প্রয়োজনীয় সব ধরনের পণ্যের দাম তুলনা মূলক অনেক বেশি। অন্যদিকে করোনায় ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব। তাতে শ্রমজীবী মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এদিকে বাজারে পণ্যের সরবরাহ ও আমদানি স্বাভাবিক থাকার পরও প্রতি বছরের মতো এবারও রমজান ঘিরে কিছু অসাদু ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার লোভে কারসাজি শুরু করেছে। সরবরাহ সংকটের অজুহাতে রমজান শুরুর আরো দুই মাস পূর্বে ধাপে ধাপে বাড়ানো হয়েছে একাধিক পণ্যের দাম। তাদের মতে, সাধারণত রমজান এলেই মানুষের মধ্যে একটু বেশি পরিমাণে নিত্য-পণ্য কেনার প্রবণতা দেখা যায়। তবে এবার করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে গত ২৫শে মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার,এবং জনগণকে ঘরে থাকতে নির্দেশ দেন।

কুমিল্লার বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায় অন্য বছরের তুলনায় এবারের রমজানে কাঁচা বাজারে ক্রেতাদের ভিড় কিছুটা কম হলেও গত কয়েকদিনের তুলায় গতকাল শুক্রবার এবং আজ শনিবার সকালের দিকে বেশ ভিড় দেখা গেছে। জনগণকে নিত্যপণ্য বিশেষ করে ইফতার সামগ্রী বেশি পরিমাণে কিনতে দেখা যায়। তাই বাড়তি চাহিদা থাকায় বেশ বেড়েছে ইফতার সামগ্রীসহ মুরগি ও সবজির দাম।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, গত সপ্তাহের তুলনায় এ সপ্তাহে প্রতি কেজি মাঝারি আকারের মসুর ডালের দাম বেড়েছে ২৩.৫৩ শতাংশ। ৭ দিনে কেজিতে পিয়াজের দাম বেড়েছে ২১.০৫ শতাংশ। সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি আদার দাম বেড়েছে ১৮.১৮ শতাংশ। রসুনের দাম বেড়েছে ২০ শতাংশ। মাসের ব্যবধানে কেজিতে ছোলার দাম বেড়েছে ৬.৯০ শতাংশ। প্রতি কেজি চিনিতে দাম বেড়েছে ৩.৭০ শতাংশ। এছাড়া কেজিতে ৯.৯ শতাংশ বেড়েছে খেজুরের দাম।

দাম বাড়ার বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিদিন বাজার তদারকি করা হচ্ছে। যেসব পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে, তা কোন কারণে বেড়েছে তা আমরা খতিয়ে দেখছি। কোন ধরনের অনিয়ম পেলে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। কাউকেই ছাড় দেয়া হচ্ছে না।

এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনা পরিস্থিতি ও রমজানে নিত্যপণ্যের দাম ভোক্তা সহনীয় রাখতে সংশ্লিষ্টদের বারবার নজর রাখতে বলেছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে একাধিক সংস্থা বাজার তদারকিতেও নেমেছে। এরপরও এসব কার্যক্রমকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অসাধুরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে চলছে।

কুমিল্লার নিমসার পাইকারী কাচাঁ বাজার ,শহরের রাজগঞ্জ বাজারসহ বেশ কয়েকটি বাজার ঘুরে এসব পণ্যের কোনও ধরনের সংকট দেখা যায়নি। বরং চাহিদার তুলনায় প্রতিটি দোকানে বেশি মজুত লক্ষ্য করা গেছে। অন্যদিকে ট্যারিফ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী এসব পণ্যের আমদানি পরিস্থিতিও পর্যাপ্ত বলা হয়েছে। কিন্তু বাজারে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী করোনা পরিস্থিতিতে পরিবহনের অভাবে সরবরাহের ঘাটতির কথা বলে এসব পণ্যের দাম বাড়িয়েছে।

টিসিবির বাজারদর পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ৬৫-৭৫ টাকা। যা এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ৬৫-৭০ টাকা। রসুন বিক্রি হয়েছে ১১০-১৩০ টাকা কেজি। যা এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ৮০-১২০ টাকা। প্রতি কেজি দেশি পিয়াজ বিক্রি হয়েছে ৫৫-৬০ টাকা। যা এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ৪৫-৫০ টাকা। আমদানি করা পিয়াজ বিক্রি হয়েছে ৫০-৫৫ টাকা। যা এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ৪০-৫০ টাকা। প্রতি কেজি আমদানি করা আদা ৩০০-৩৫০ টাকা। যা এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ২৫০-৩০০ টাকা। এছাড়া বাজারে প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হয়েছে ৮০-৮৫ টাকা। যা এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ৭৫-৮০ টাকা।
টিসিবি’র তথ্য মতে, প্রতি কেজি খেজুর বিক্রি হয়েছে ২৫০-৩৫০ টাকা। যা এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ২৫০-৩০০ টাকা। মসুর ডাল (ছোট দানা) বিক্রি হয়েছে ১৩০-১৪০ টাকা কেজি। যা এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ১২০-১৩০ টাকা।
কুমিল্লার রাজগঞ্জ বাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা আলমগীর বলেন, রমজান আসার এক মাস আগ থেকেই বিক্রেতারা একাধিক পণ্যের দাম বাড়াতে শুরু করেছে। তবে সব থেকে এই এক সপ্তাহে বেশি বাড়াচ্ছে। কারণ প্রতি বছরের মতো এবারও বিক্রেতারা কারসাজি করছে। দেশের এই করোনা পরিস্থিতিতেও তারা অতি মুনাফা করতে ভোক্তার পকেট কাটছে।

একই বাজারের মুদি ব্যবসায়ী মনির বলেন, পাইকাররা সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। যার কারণে বেশি দাম দিয়ে এনে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে বাজারে যেসব পণ্যের দাম বেড়েছে তার কোন সংকট নেই। প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পণ্য আছে।

কুমিল্লা নিমসা বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলেন, সব ধরনের পণ্য আছে। গত বছরের তুলনায় আমদানিও অনেক ভালো। তবে করোনায় পরিবহন সংকটের কারণে বেশি ভাড়া দিয়ে পণ্য আনতে হচ্ছে যে কারণে দাম বাড়তি।
খুচরা চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, মোটা আতপ চাল প্রতি বস্তা বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ১৯০০ থেকে ২ হাজার টাকা। গত সপ্তাহে যা ১৭০০ থেকে ১৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। মোটা সিদ্ধ চাল বিক্রি হচ্ছে ২০৫০ থেকে ২১০০ টাকায়। আগে তা বিক্রি হয়েছিল ১৮০০ টাকায়। স্বর্ণা সিদ্ধ চাল বিক্রি হচ্ছে ২২৫০ টাকায়। গুটি সিদ্ধ চাল বিক্রি হচ্ছে ২১৫০ থেকে বেড়ে ২৪০০ টাকা। ১৯০০ টাকা দামের বেতি আতপ চাল এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি বস্তা ৩০০ টাকা বেড়ে ২২০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া মিনিকেট, জিরাশাইল, পাইজামসহ সব ধরনের চাল বস্তায় সর্বনিম্ন ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে।
গত এক সপ্তাহ ব্যবধানে বাজারে রমজানে খুব প্রয়োজনীয় চারটি ভোগ্যপণ্য- ছোলা, ডাল, চিনি ও ভোজ্যতেলের দামও হু-হু করে বেড়ে গেছে। মজুদ করে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করার কারণে এমনটি হচ্ছে বলে বাজার বিশ্লেষকদের অভিযোগ করেন। তারা বলছেন, এখনই সরকারের উচিত বাজার তদারকির ব্যবস্থা করা।

 রাইস মিলের মালিক আলী আশ্রাফ জানান, চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চালের দাম বাড়ছে। মিল মালিকদের হাতে কোন চাল নেই। যা ছিল দাম বাড়ার আগেই বিক্রি করে দিয়েছে। এখন উত্তরবঙ্গ থেকে এনে বিক্রি করতে হচ্ছে। পরিবহন সংকটের কারণে চালের সরবরাহ কমে গেছে। সংকটের কারণে দাম বেড়েছে।
এদিকে খুচরা বাজারে ৩৫ টাকার পিয়াজ এক সপ্তাহের ব্যবধানে দ্বিগুণ বেড়ে ৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সব ধরনের খেজুরের দামও বেড়েছে। খেজুর প্রতি কেজিতে বেড়েছে ১০০ থেকে ২০০ টাকা। ৫০ কেজির প্রতি বস্তা চিড়ার দাম ১৮০০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২৭০০ টাকা। এই দাম বৃদ্ধির জন্য পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা আবার পরস্পরকেও দুষছেন।
বিভিন্ন কাঁচাবাজার ঘুরে দেখা গেছে, বড় দানার মসুরের ডাল গত সপ্তাহের তুলনায় ১৫ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। শুক্রবার এ ডাল বিক্রি হয়েছে প্রতি কেজি ৯০-১০০ টাকা। গত সপ্তাহে যা ছিল ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। মাঝারি দানার মসুর ডাল আজ বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ টাকায়; গত সপ্তাহে যা ছিল ৮০ থেকে ৯৫ টাকা। এছাড়া ছোট দানার মসুরের ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৩০-১৪০ টাকায়,গত সপ্তাহে যা ছিল ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা। তবে মুগ ডাল আগের দামেই তথা ১৩০ থেকে ১৪৮ টাকায় এবং অ্যাংকর ডাল ৪০ থেকে ৪৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।

চিনির দাম প্রতি কেজিতে পাঁচ টাকা বেড়েছে। গত শুক্রবার এবং আজ শনিবার প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয় ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। গত সপ্তাহে যা ছিল ৬৫ থেকে ৭৫ টাকা। পিয়াজের দাম বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা, গত সপ্তাহে যা ছিল ৫০ থেক ৬০ টাকা। আমদানি করা আদার দাম বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। গতকাল শুক্রবার চিনের আদা প্রতি কেজি ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হতে দেখা গেছে, গত সপ্তাহে যা ছিল ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। এছাড়া দেশি আদা ২৩০ টাকা থেকে ২৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, গত সপ্তাহে যা ছিল ২২০ থেকে ২৫০ টাকা।

এদিকে সবজির পাশাপাশি বেড়েছে ব্রয়লার ও দেশি মুরগির দাম। গত সপ্তাহে ১০০-১১০ টাকা কেজি বিক্রি হওয়া ব্রয়লার মুরগির দাম বেড়ে ১২০-১৩০ টাকা হয়েছে। দেশি মুরগি বিক্রি হচ্ছে ৪০০-৪৫০ টাকা কেজি, যা গত সপ্তাহে ছিল ৩৫০-৪০০ টাকা। মুরগির দাম বাড়লেও অপরিবর্তিত রয়েছে ডিম এবং গরু ও খাসির মাংসের দাম। ডিমের ডজন আগের মতোই ৭৫-৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহের মতই গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬০০ টাকায়। খাসির মাংসের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০০-৯০০ টাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published.