কুমিল্লায় ভেকু ড্রেজার ড্রামট্রাক ট্রাক্টরে ক্ষতবিক্ষত গোমতী! দেখার নেই কেউ

অপরাধ

মাহফুজ বাবু :
ওপাড়ের পাহাড়ী ঢাল বেয়ে কুমিল্লা জেলার ওপর দিয়ে এঁকেবেকে ৫৮ কিলোমিটার বয়ে চলা জোয়ার-ভাটাহীন নদীটির নাম গোমতী। আর এই গোমতীর দুপাশের চর যেন কৃষকদের জন্য আশীর্বাদ। চলছে শীতকাল, কুমিল্লা গোমতীর চরের উর্বর পলিমাটিতে শীতকালীন আগাম সবজি উৎপাদনে ব্যাস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। নদীর চরের উর্বর পলি মাটি ও সেচের সুবিধা থাকায় প্রায় সারা বছরই সবজির ভালো ফলন হয় এখানে। মাটির উর্বরতা ভালো হওয়ায় ধান সহ প্রায় সব ধরনের সবজির চাষই ভালো হয় চরে। এছাড়াও নদীর দুই ধারে প্রতিরক্ষা বাঁধ তার ওপর পাকা সড়কে ও উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারনে গোমতী চরে চাষাবাদ করেই জীবিকা নির্বাহ করে হাজারো পরিবার।

ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থার কারনে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ব্যাপারীরা চরে উৎপাদিত ফসল সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কিনে নিয়ে নিমসার, ফেনী, চট্টগ্রাম ও ঢাকার তেজগাঁও সহ দেশের বড় বড় পাইকারী বাজারে বিক্রি করেন। দালাল বা ফরিয়া ব্যাবসায়ীদের দৌরাত্ম্য না থাকায় পরিশ্রমের সঠিক মূল্যও পায় চরের কৃষকরা। কৃষকদের অনেকেই আবার নিজেদের ক্ষেতের সবজি পাইকারি ও খুচরা বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন নিজেরাই। শীতকালীন আগাম শাক সবজির চাহিদা যেমন বেশী তেমনি দামও পাওয়া যায় ভালো। কৃষি কাজের আদর্শ ভূমি এই গোমতী চরে শীতকালীন শাক সবজির ভেতরে রয়েছে পাতাকপি, ফুলকপি, লাউ, সীম, লালশাক, ঢেড়স, গোলআলু, মিষ্টি আলু, কুমড়া, ডাটা, মূলা, ধনিয়া, কাঁচামরিচ ও পালংশাক, সরিষা, শাসা, সহ নানা জাতের সবজি ও ফসল। সব মিলিয়ে চাষাবাদের উৎকৃষ্ট ভূমি এই গোমতীর চর।

চরের উভয় পাশের বিস্তীর্ণ সবুজ শাক সবজি ও সবুজের সমারোহে চোখ জুড়িয়ে যায়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পিপাসুদের জন্য নগীর অদুরে এই গোমতীর তীরে গড়ে ওঠেছে পার্ক কফিসপ সহ বিনোদন কেন্দ্র। এছাড়াও নগরীর টিক্কারচর শুভপুর এলাকার চরে একটি স্টেডিয়াম তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের। সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে এ গোমতী নদী হয়ে উঠতে পারে পর্যটন সম্ভাবনাময় বিশেষ একটি খাত।

তবে চরের সবুজের সমারোহ ও নদীর সৌন্দর্য বিবর্ণ করতে শীতকাল বা শুষ্ক মৌসুমে ইটভাটা মালিক ও মাটিখেকো দস্যুদের ড্রেজার, দানব ভেকু মেশিন অবৈধ ট্রাক্টর ও ড্রামট্রাকের দৌরাত্ম্যে ক্ষতবিক্ষত হয় হয় গোমতীর চর। সম্প্রতি রীতিমত ভেকু ও ড্রেজারে ফসিল জমীর মাটি কাটার প্রতিযোগিতা চলছে। বালুমহাল বা ঘাট ইজারার নিয়ম অনুযায়ী পরিকল্পিত ভাবে নদী ড্রেজিং ও বালু উত্তোলন করার কথা থাকলেও ঠিকাদাররা তা মানছে না মোটেই। আইন অনুযায়ী কৃষি চাষাবাদ যোগ্য জমীর মাটি কাটতে হলে কৃষি বিভাগের অনুমোদন নেয়ার কথা থাকলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় কাগুজে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দেদারছে কেটে নেয়া হচ্ছে চরের একরের পর একর উর্বর পলি মাটি।

কৃষি বান্ধব বর্তমান সরকার যখন ভর্তুকি দিয়ে কৃষকদের বিনামূল্যে সার কীটনাশক বীজ সহ কৃষি উপকরণ দিয়ে কৃষকদের চাষাবাদে উৎসাহ যোগাচ্ছ। তখন সরকারি দলের নাম ভাঙ্গিয়ে প্রভাবশালী স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের পরিচয়ে মাটি খেকো সিন্ডিকেট, ইট ভাটা মালিক ও ঠিকাদাররা কৃষি জমি উজার করে গোমতী চরের উর্বর মাটি লুটের মহোৎসবে মেতেছে। চর ও মাটি খেকো প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের অর্থ ও পেশী, রাজনৈতিক শক্তির কাছে অসহায় স্থানীয় কৃষকদের করার যেন কিছুই নেই। মাটি কাটা এসব সিন্ডিকেটের বেশীরভাগই সরকারি দলের নেতাকর্মী।

বিভিন্ন সময় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের নিকট অভিযোগ করেও বিশেষ কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না তারা। নাম মাত্র মূল্য দিয়ে চরের চাষযোগ্য জমীর মাটি কটে নিলেও প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের হাতে নির্যাতিত হওয়ায় ভয়ে নিরব থাকতে হচ্ছে চরের কৃষকদের। চরের ফসলি জমির মাটি কাটা রোধে মানববন্ধনও করেছে বলে জানায় স্থানীয় কৃষকরা। দিন কিবা রাত ২৪ঘন্টাই চলছে চরের ফসিল জমি থেকে মাটি কাটার এই মহোৎসব। দানব ভেকু, ড্রেজার, মাটিবাহী ড্রামট্রাক ও ট্রাক্টরের শব্দে আর সড়কের ধুলায় চাপা পরছে কৃষকের মুখের হাসি। ইচ্ছে না থাকলেও মাটিখেকো সিন্ডিকেটের অপকৌশলের কাছে হার মানতে হচ্ছে চরের কৃষকদের।

কোটি টাকার মাটি বিক্রি হচ্ছে প্রতিদিনই । চরের এই মাটি কাটার ফলে শুধু যে কৃষকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়। হাজার কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত নদীর দুপাশের প্রতিরক্ষা বাঁধ এবং নদীর ওপরের ব্রিজগুলোও পরেছে হুমকির মুখে। অনেক স্থানেই বাঁধ ও ব্রিজের কিনার ঘেষে গভীর গর্ত করে কেটে নেয়া হচ্ছে মাটি। নদীর নির্ধারিত কিছু পয়েন্ট থেকে বালু উত্তোলনের ইজারা থাকলেও গোলাবাড়ি জিরো পয়েন্ট থেকে শুরু করে, কুমিল্লা আদর্শ সদর, বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, দেবীদ্বার, মুরাদনগর তিতাত ও দাউদকান্দি উপজেলার শত শত পয়েন্টে অবৈধ ভাবে ফসিল জমির মাটি কাটা হচ্ছে অবাধে । মাটি কাটার এসব পয়েন্টে অবৈধ ভাবে বাঁধ কেটে তৈরী করা হচ্ছে পরিবহন ওঠানামার জন্য ডাইভেশন সড়ক। প্রতিরক্ষা বাঁধ ছিদ্র করে কিংবা বাঁধের ওপর সড়কে বিশাল আকারের স্পডব্রেকার তৈরি করে পাইপ দিয়ে ড্রেজার দিয়ে নগরী ও নগরীর বাইরে ভরাট করা হচ্ছে জলাশয় ও পুকুর। মাটি বাহি ভারী পরিবহন চলাচলের কারনে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা ব্যায়ে গ্রামীণ অবকাঠামো অনুযায়ী নির্মিত বাঁধ ও আশেপাশের দুর্বল সংযোগ সড়কগুলো ভেঙ্গেচুরে নষ্ট হচ্ছে বছর না ঘুরতেই। চরের উর্বর জমী ধ্বংস করে একদিকে পরিবেশ বিপর্যয়কারী ইটভাটায় ইট তৈরি হচ্ছে আরেক দিকে পুরোনো জলাশয় পুকুর ও খাল ভরাট করা হচ্ছে অবৈধভাবে।

দিনের আলোতে ও রাতের আধারে মাটি কাটার এ মহোৎসব চললেও জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর, পানি উন্নয়ন বোর্ড, উপজেলা ও জেলা প্রশাসন বা অজুহাতের যেন শেষ নেই। বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোও অনেকটাই নিরব ভুমিকায়। কৃষি জমি, বাঁধ সড়ক, জলাশয়, ব্রিজ ও পরিবেশের ওপর বিস্তর প্রভাব পরলেও সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী প্রশাসন লোকবল সংকট সহ দেখান নানা অজুহাত। নিজেদের দায় এড়াতে উদুর পিন্ডি বুদুর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা করে বসে আছেন হাত গুটিয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীরা।

সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই চলেছে এসব অপকর্ম। মাটি কাটা সিন্ডিকেট এর ভাগের টাকা যায় ওসব দপ্তরেও। অবৈধ ও নাম্বার বিহীন মাটিবাহী এসব ড্রামট্রাক ও ট্রাক্টরগুলো নয়তো সড়ক দাপিয়ে চলছে কি করে?কৃষকদের এত ক্ষয়ক্ষতির পরেও কেনই বা তারা অপকর্মকারীদের বিরুদ্ধে নিচ্ছেন না তেমন কোন কার্যকর পদক্ষেপ, এমন প্রশ্ন চরের ভুক্তভোগী কৃষক ও সচেতন নাগরিকদের।

যাথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করার ফলে দিনদিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে গোমতী চরের মাটি খেকো সিন্ডিকেট। জলবায়ু ও পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকানো সহ কৃষি জমি, বাঁধ, সড়ক, জলাশয় রক্ষায় আইন প্রয়োগকারী সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ও কৃষি বান্ধব বর্তমান সরকারের কর্মকর্তারা কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহনের পাশাপাশি চরের কৃষকদের পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসবেন এমনটাই আশা করেছেন গোমতী চরের কৃষকরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published.